মায়েরা যেন বাড়িতেই নিরাপদ প্রসব করতে পারেন, এ ব্যাপারে মিডওয়াইফরা সবচেয়ে ভালো ভূমিকা রাখতে পারেন। মা ও নবজাতকের স্বাস্থ্যসেবায় মিডওয়াইফদের আরও আন্তরিক ও মমতাময়ী হতে হবে। তবে মিডওয়াইফদের কাছ থেকে ভালো স্বাস্থ্যসেবা পেতে তাঁদের কর্মস্থলে পর্যাপ্ত অবকাঠামো ও নিরাপত্তাব্যবস্থা রাখতে হবে বলে মনে করেন বক্তারা।
আজ মঙ্গলবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে ‘প্রথম আলো’ কার্যালয়ে ‘বাংলাদেশে মা ও নবজাতকদের স্বাস্থ্যসেবায় পেশাদার মিডওয়াইফ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এমন অভিমত দেন। গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজক ছিল ‘প্রথম আলো’ ও জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ)।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ‘আমরা চাই বাড়িতেই ডেলিভারি হোক। এ জন্য প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, শতকরা ৮০ ভাগ হোম ডেলিভারি হোক। অর্থাৎ আমাদের সন্তানেরা বাড়িতে জন্মগ্রহণ করুক। এ ব্যাপারে মিডওয়াইফরা সবচেয়ে বেশি কাজ করবে। তিন হাজার মিডওয়াইফ নিয়োগপ্রক্রিয়া শুরু করেছি। ৬০০ নিয়োগ ইতিমধ্যে হয়ে গেছে, আরও হবে।’
মিডওয়াইফ পেশার আগ্রহী নারীদের উদ্দেশ করে মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ‘আমরা যতই সুন্দর ভবন বানাই না কেন, লজিস্টিক সাপোর্ট দিই না কেন, আমাদের দরকার মিডওয়াইফদের একটি মমতাময়ী হাত। থানা পর্যায়ে সুন্দর একটি এয়ারকন্ডিশন ভবন বানিয়ে দিলাম। কী লাভ হবে যদি আমাদের মমতাময়ী হাত না থাকে, সেবা না করি?’
নাসিম বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী ১০ হাজার নার্স নিয়োগের কথা বলেছেন। ইতিমধ্যে এর নিয়োগপ্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। আমাদের নার্স ও মিডওয়াইফ যত প্রয়োজন আছে, তত করব। তবে সম্পদ সীমাবদ্ধ, এটা মনে রাখতে হবে। মিডওয়াইফদের সংখ্যা বাড়ানো হবে এবং আনুষঙ্গিক সব ধরনের সহায়তাও দেওয়া হবে।’ বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে বাচ্চা প্রসবের কক্ষ নোংরা থাকার কথা উল্লেখ করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম।
নিরাপদ মাতৃস্বাস্থ্য উন্নয়ন ও নিরাপদ প্রসবসংক্রান্ত সংসদীয় উপকমিটির সদস্য হাবিবে মিল্লাত স্বাস্থ্য খাতে আরও বাজেট বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দেন। তিনি বলেন, ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশ করতে গেলে স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বাড়াতে হবে। বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ কমাতে পারলে মাতৃমৃত্যুর হার আরও কমানো সম্ভব হবে। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় যেভাবে নারীর ওপর নির্যাতনের তথ্য জানাতে হটলাইন চালু করেছে, এর আদলে মাতৃ ও নবজাতকদের স্বাস্থ্যসেবার জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে হটলাইন চালুর কথা বলেন তিনি।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ ওয়াহিদ হোসেন বলেন, ইউনিয়ন পর্যায়ের পরিবারকল্যাণ পরিদর্শকদের মিডওয়াইফ প্রশিক্ষণ দিলে তাঁদের কাজে লাগানো সম্ভব হবে। নার্সিং কলেজ বা ইনস্টিটিউটগুলোতে এ বিষয়ে ছয় মাস বা এক বছরের একটি সংক্ষিপ্ত কোর্স চালুরও পরামর্শ দেন তিনি। এ সময় নবজাতকদের প্রসবের জন্য এক হাজার বিশেষ টেবিল কেনার কথা উল্লেখ করেন তিনি।
বৈঠকের শুরুতে মা ও নবজাতকের স্বাস্থ্যসেবায় মিডওয়াইফদের নিয়ে একটি তথ্যচিত্র দেখান ইউএনএফপিএর বিশেষজ্ঞ উপদেষ্টা সৈয়দ আবু জাফর মোহাম্মদ মুসা। গোলটেবিল সঞ্চালনা করেন ‘প্রথম আলো’র সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম।
গোলটেবিল বৈঠকে সেবা পরিদপ্তরের পরিচালক নিলুফার ফরহাদ বলেন, সারা দেশে ২০ হাজারের মতো মিডওয়াইফ দরকার। তবে যেসব মিডওয়াইফ প্রত্যন্ত এলাকায় কাজ করতে যাবেন, সেখানে তাঁদের জন্য নিরাপত্তাব্যবস্থা থাকতে হবে। কারণ তাঁদের নিরাপত্তা না থাকলে তাঁরা ভালো সেবা দিতে পারবেন না।
বাংলাদেশ নার্সিং কাউন্সিলের রেজিস্ট্রার সুরাইয়া বেগম বলেন, ‘আমরা যারা এখানে আছি, মন্ত্রী মহোদয়সহ সবাই স্বাভাবিকভাবে জন্মগ্রহণ করেছেন। কিন্তু এখন যেন আমরা স্বাভাবিক প্রসব থেকে অনেক সরে এসেছি। এ জন্য আমাদের দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে প্রসবের হার এত বেশি।’
অভিনয়শিল্পী মুনিরা ইউসুফ মেমী বলেন, ‘আমি মানসিকভাবে একটা প্রস্তুতি নিয়েছিলাম যে, আমার নরমাল বেবি হবে। আমার সিজারিয়ান বেবি হবে না। আমার মনে হয়, এ রকম মানসিক প্রস্তুতি একজন মা ও তাঁর পরিবারের থাকা উচিত।’ মা ও নবজাতকের স্বাস্থ্যসেবায় সংশ্লিষ্ট সবাইকে সমন্বয় করে কাজ করার পরামর্শও দেন তিনি।
মিটফোর্ডের নার্সিং ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ সামসুন নাহার বলেন, মিডওয়াইফ শিক্ষার্থীদের যদি কমিউনিটি ভিত্তিতে পদায়ন করা যেত, তাহলে এ পেশায় সবাই উৎসাহিত হতো।
ইউএনএফপিএর ন্যাশনাল প্রোগ্রাম অফিসার ফরিদা বেগম বলেন, ‘অনেক জায়গায় অবকাঠামোগত কারণে মিডওয়াইফ দেওয়া যাচ্ছে না। সরকারকে অনুরোধ করব এদিকে নজর দিতে। ইউএনএফপিএ যে সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে, সেটা দিয়ে যাবে।’
নার্সিং ও মিডওয়াইফারি কর্মকর্তা রহিমা জামাল আক্তার বলেন, মিডওয়াইফারি পড়াশোনার পাশাপাশি এ বিষয়ে প্রচারণামূলক কর্মসূচিও থাকতে হবে। এ জন্য মিডওয়াইফারি শিক্ষার্থীসহ সংশ্লিষ্টদের প্রচারণামূলক কর্মসূচি গ্রহণের আহ্বান জানান তিনি।
সেবা পরিদপ্তরের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. মফিজুল্লাহ বলেন, ‘আমাদের ফোকাস করতে হবে, কীভাবে প্রত্যন্ত অঞ্চলে মা ও শিশুদের স্বাস্থ্যসেবায় এগিয়ে আসা যায়। এ জন্য প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত তিন হাজার মিডওয়াইফের সংখ্যা বাড়াতে হবে।’
ময়মনসিংহ নার্সিং কলেজের মিডওয়াইফারি বিভাগের শিক্ষার্থী ক্যাথরিন স্নিগ্ধা বালা বলেন, ‘আমাদের প্রতিষ্ঠানের নবজাতকদের বিভাগটি অত্যন্ত সুন্দর ও পরিপাটি। এখান থেকে যেসব ছাত্রী বের হয়ে আসছেন, আশা করি তারা অনেক ভালো করবেন।’
মিডওয়াইফ কোর্সের শিক্ষার্থী সৈয়দা মাহফুজা আক্তার বলেন, ‘আমি এই কোর্সের শিক্ষার্থী হিসেবে গর্বিত। সরকার যে লক্ষ্যে এই কোর্স চালু করেছে, সেটা পূরণের চেষ্টা করব।’
রেজিস্টার্ড মিডওয়াইফ তাহমিনা আক্তার বলেন, ‘একজন প্রসূতি মায়ের কীভাবে স্বাস্থ্যসেবা দিতে হবে, যত্ন নিতে হবে, এই কোর্স করার পর আমরা এখন বুঝতে পারি।’
পাঠকের মতামত: